Skip to main content

রাষ্ট্রতত্ত্বের সমস্যা (Problems of Political Theory)

*

সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনের সাথে রাষ্ট্রীয় মতবাদের স্বরূপ ও প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটে থাকে। প্রাচীন কালের প্রকাশিত অধিকাংশ রাজনৈতিক মতবাদই বর্তমান যুগে প্রচলিত নয়। প্লেটো ও এরিষ্টটলের তত্ত্বগুলো বর্তমান রাষ্ট্রে পুরো মাত্রায় প্রতিফলিত হচ্ছে না। প্লেটো ও এরিষ্টটল গণতন্ত্রকে নিকৃষ্ট সরকার বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু বর্তমান কালে গণতান্ত্রিক শাসনব্যাবস্থা শ্রেষ্ঠ শাসনব্যবস্থা হিসেবে বিবেচিত। এরিষ্টটল দাস প্রথাকে অত্যাবশ্যকীয় বলে বর্ণনা করেছেন । কিন্তু বর্তমান যুগে দাস প্রথা নিষিদ্ধ। সুতরাং রাষ্ট্রতত্ত্বের প্রধান সমস্যা এই যে এটা সকল ক্ষেত্রে চিরন্তন সত্য বলে প্রমাণিত হয় না । গ্রীক দর্শনের স্কলাষ্টিক যুগের অবসানের পর হেলেনীয় (Hellenistic) রাষ্ট্রীয়দর্শনের উদ্ভব হয়। হেলেনীয় দার্শনিকগণ প্লেটো এরিষ্টটলের নগররাষ্ট্রের আদর্শ পরিত্যাগ করে বিশ্বরাষ্ট্রের আদর্শ প্রচার করেন। তাঁরা মানব ঐক্যের মহান আদর্শ প্রচার করে ব্যক্তি মর্যাদাকে উন্নীত করেন। আবার হেলেনীয় যুগের অবসানের পর রোমান আইনবিদ ও চিন্তাবিদগণ রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থাকে জনগণের সম্পত্তি ও আইনের উপর প্রতিষ্ঠিত করার আদর্শ প্রচার করেন।

রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কিত সমস্যা
রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে যুগে যুগে বিভিন্ন মতবাদ উদ্ভাবিত হয়েছে। গ্রীক দার্শনিকদের মতে মানুষের সংঘবদ্ধ হয়ে বসবাস করার প্রবণতাই রাষ্ট্রের উৎপত্তির মূল কারণ। মধ্যযুগে রাষ্ট্রকে ঈশ্বরের সৃষ্টি বলে বর্ণনা করা হয়। আবার কারো মতে শক্তি ও বল প্রয়োগের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে বলা হল রাষ্ট্র হল সামাজিক চুক্তির ফসল । আধুনিক যুগে অধিকাংশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, “রাষ্ট্র ঐতিহাসিক বিবর্তনের ধারায় জন্মলাভ করেছে।”

সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে ক্ষমতা বন্টন সম্পর্কিত সমস্যা
শাসনব্যবস্থার উন্নতি কল্পে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে ক্ষমতা বন্টন নীতি একটি জটিল সমস্যা। প্রাচীন কাল থেকেই শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ প্রচারিত হয়েছে। গ্রীক দার্শনিক এরিস্টিটল তিন ধরণের ক্ষমতার কথা উল্লেখ করেছেন:
১। শাসনমূলক
২। আইন সম্পৰ্কীয় ও
৩। বিচার বিষয়ক
প্রাচীন এবং মধ্যযুগেও ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণনীতি পন্ডিতগণের আলোচনার বিয়য়বস্তু ছিল। মারসিলিও অব পদুয়ার শাসন বিভাগ ও আইন পরিষদের পার্থক্য নির্ণয় করেন। রোমান আইনজীবি সিসেরো এবং পলিবিয়াস উভয়েই ক্ষমতা পৃথকীকরণের কথা উল্লেখ করেছেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফরাসী লেখক মন্টেস্কু 'The Spirit of Laws' নামক গ্রন্থে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণনীতির পরিপূর্ণ তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। আজও ব্রিটেনে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার প্রচলিত থাকায় সেখানে ক্ষমতা পৃথকীকরণ নীতি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। কারণ ব্রিটেনে ক্যাবিনেট ও মন্ত্রিপরিষদের সদস্যগণ পার্লামেন্টেরও সদস্য তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণনীতির বাস্তবায়ন বেশী ঘটেছে। তা সত্ত্বেও সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে শাসন ক্ষমতার পরিধি নিয়ে সমস্যার সৃষ্টি হয়ে থাকে। তা' ছাড়া ক্ষমতা পৃথক করার সাথে ক্ষমতার সমন্বয় ও ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় সমস্যা জড়িত।

রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব সম্পর্কিত সমস্যা
রাষ্ট্রের স্বার্বভৌমত্বের প্রকৃত ব্যাখা নিয়ে যুগে যুগে বহু মতবাদ প্রচারিত হয়েছে। মধ্যযুগে মনে করা হতো ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে পোপ হল রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার কর্ণধার। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে বিশ্বাস করা হত যে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের অধিকারী রাজশক্তি। গণতন্ত্রের বিস্তার লাভের ফলে এ ধারণার পরিবর্তন সূচিত হয়। স্বৈরাচারী শাসনের পরিবর্তে জনগণের সার্বভৌমত্ব মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানকালে জনগণই হল সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী এমন মনে করা হয়।

শাসক শাসিতের মধ্যে বিদ্যমান সমস্যা
গণতান্ত্রিক আদর্শের উৎকর্ষের ফলে জনগণ স্বৈরাচারী রাজশক্তির বিরুদ্ধে গণআন্দোলন শুরু করে । জনসাধারণ জোরালো দাবি উত্থাপন করে যে, রাষ্ট্র শক্তির মূলে রয়েছে জনগণ। ফলে এ বিষয়ে নানা ধরনের মতবাদ সৃষ্টি হয়। এই সময় নৈরাজ্যবাদ, ও সমাজতন্ত্রের মতবাদ উদ্ভবের ফলে গণতন্ত্র ব্যহত হয়। বিংশ শতাব্দির প্রারম্ভে বিভিন্ন ঐতিহাসিক কারণে ইউরোপে গণতন্ত্রের বিপরীতে ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদের উদ্ভব ঘটে। বর্তমান যুগেও শাসক-শাসিতের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক একটি প্রধান সমস্যা।

রাষ্ট্র ও ব্যক্তির মধ্যে সম্পর্ক
রাষ্ট্র ও ব্যক্তির মধ্যে পারস্পারিক সম্পর্ক নির্ধারণ নিয়ে যুগে যুগে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। গ্রীক দার্শনিকদের ধারণা মতে বলা যায় ব্যক্তি রাষ্ট্রের জন্য ব্যক্তির জন্য রাষ্ট্র নয়। আধুনিক যুগে রাষ্ট্র ব্যাক্তির জন্য রাষ্ট্রের জন্য ব্যক্তি নয় বলে মনে করা হয়। একদিকে পুরাতন সমস্যার সমাধান হলেও অন্যদিকে নতুন সম্যাসার উদ্ভব হয়েছে। জন স্টুয়ার্ট মিল ও হার্ভার্ট স্পেনসার এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন তবুও আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের কাছে এটি এক জটিল সমস্যা। বস্তুত ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের পারস্পারিক সম্পর্কের সমাধান আজও কেউ দিতে পারেনি। এ ব্যাপারে যারা আলোচনা করেছেন তাঁদের মতবাদও চুড়ান্ত নয় ।

ভাববাদী ও বস্তুবাদী রাষ্ট্রতত্ত্ব সম্পর্কিত সমস্যা
আদর্শ নির্ভর ভাববাদ ও বস্তুনির্ভর রাষ্ট্রতত্ত্ব রাজনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব। প্লেটো থেকে শুরু করে কার্লমার্ক্স পর্যন্ত এ সমস্যা রাষ্ট্রতত্ত্বকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছে। অদ্যবধি এ দ্বন্দ্বের অবসান হয় নি।

Comments