*
আদি কাল থেকেই সমাজ, রাষ্ট্র, সরকার ও শাসন ব্যবস্থার সাথে নীতিবিদ্যার এক গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে। গ্রীক, দার্শনিকগণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাথে নীতিশাস্ত্রের ঘনিষ্ট সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেছেন। দার্শনিক প্লেটো তার গ্রন্থ “The Republic' এ আদর্শ ভিত্তি হিসাবে নৈতিকতার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাথে নীতি শাস্ত্রের একটি সুন্দর চিত্র তুলে ধরেন। ন্যায়নীতি হচ্ছে উন্নত সমাজ ব্যবস্থার ভিত্তি। গ্রীক দার্শনিকগণ রাষ্ট্রকে একটি নৈতিক প্রতিষ্ঠান বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁদের মতে শাসক নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হলে শাসন ব্যাবস্থা কল্যাণমুখী হয়। নীতিশাস্ত্র মানুষের ন্যায় অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে সাহায্য করে। রাষ্ট্রের অস্তিত্ব সুন্দর জীবন যাপনের জন্য (The state continues to exist for the sake of good life)। এরিষ্টটল নৈতিকতার মাপকাঠি দিয়েই রাষ্ট্রীয় দোষ গুন বিচার করেছেন। উল্লেখ্য যে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান নাগরিকের দায়িত্ব-কর্তব্য ঠিক করে দেয়। নীতিবিদ্যা মানুষের চিন্তা ও কাজে বহিঃপ্রকাশের মানদন্ড নির্ধারণ করে দেয়। রাষ্ট্র কর্তৃক প্রণীত আইনগুলোর বৈধতা নীতিশাস্ত্রের মাপকাঠিতে বিচার করা হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও নীতিশাস্ত্র উভয়েরই উদ্দেশ্য মানুষের সর্বাঙ্গীন উন্নতি ও কল্যাণ সাধন ।
ঐতিহাসিক লর্ড অ্যাক্টন নীতি শাস্ত্রের গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, “সরকার কি করছে তা দেখার চেয়ে বরং সরকারের কি করণীয় তা রাষ্টবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হওয়া উচিৎ” (The great question for politics is to discover not what government prescribes but what they ought to prescribe)।
আমাদের মূল্যবোধ, ন্যায় অন্যায় ধারণা মূলত নৈতিকতার মাপকাঠিতে বিচার করা হয। নীতির দিক দিয়ে যা অসংগত তা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বিধি হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। অধ্যাপক আইভর ব্রাউন বলেন নৈতিক তত্ত্বকে বাদ দিয়ে রাজনৈতিক তত্ত্ব অসার । আবার রাষ্ট্র তত্ত্ব ছাড়া নৈতিক তত্ত্ব অসম্পূর্ণ। “Ethical theory is incomplete without political theory, political theory is idle without ethical theory" তাই বলা হয় রাষ্ট্রনীতি স্পষ্টত নীতি বিজ্ঞান। নৈতিক মানদন্ডকে উপেক্ষা করে কোন রাষ্ট্রই নাগরিকের সত্যিকার কল্যাণ সাধন করতে পারে না। প্লেটো ও এরিষ্টটল রাষ্ট্রকে একটি উত্তম জীবন যাপনের সর্বোত্তম সংগঠন বলে আখ্যায়িত করেছেন। রাষ্ট্রের মূল কাজ হল সুনাগরিক তৈরী করা। নৈতিক চেতনা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র আদর্শমন্ডিত মানুষ গড়ে তুলতে সক্ষম। নৈতিক মানদন্ডকে উপেক্ষা করে রাষ্ট্র মানুষের সত্যিকার কল্যাণ করতে পারে না। মানুষের পারস্পরিক বন্ধন ও সামাজিকতা রাজনীতি ও নীতিশাস্ত্রকে সম্পৃক্ত করেছে।
কোন কাজটি ন্যায়সংগত, কোন্ কাজটি অন্যায়, কোটি গ্রহণীয় কোটি বর্জনীয় তা নীতিশাস্ত্রে আলোচিত হয়। কোন নৈতিক আদর্শ সর্বজন স্বীকৃত হলে তা রাষ্ট্রীয় আইনে রূপ লাভ করে। আবার কোন আইন নৈতিকতার পরিপন্থী বা বিপরীত ধর্মী হলে তা বাস্তবে রূপ লাভ করতে পারে না। চিন্তাবিদ ফক্স যথাযথই বলেছেন “নীতির দিক দিয়ে যা অন্যায় তা রাজনৈতিক দিক দিয়ে ন্যায় হতে পারে না” (What is morally wrong can never be politically right).
উভয় শাস্ত্রের ভিতর ঘনিষ্ট সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও বিষয় বস্তুর দিক দিয়ে নীতিশাস্ত্র ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান। রাষ্টবিজ্ঞান মানুষের রাজনৈতিক কার্যকলাপ ও বাহ্যিক আচার আচরণ নিয়ে আলোচনা করে। এটি মানুষের অভ্যন্তরীণ কার্যকলাপ ও চিন্তাধারা নিয়ন্ত্রণ করে না । নীতিশাস্ত্র মানুষের নৈতিকতা আলোচনা করে এবং বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ আচার- আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। হবস, লক, রুশো প্রমুখ চিন্তাবিদদের দর্শন রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে নীতিশাস্ত্র থেকে আলাদা করে একটি পৃথক শাস্ত্রে উন্নীত করেছে। ম্যাকিয়াভেলী তাঁর রাষ্ট্র দর্শনে নৈতিক আদর্শের পরিবর্তে সুবিধাবাদ আদর্শ প্রচার করেন। তিনি রাজনীতি থেকে নৈতিকতাকে বিচ্ছিন্ন করার প্রয়াস চালিয়েছিলেন। এভাবে রাজনীতিকে নীতিশাস্ত্র থেকে আলাদা করে স্বতন্ত্র মর্যাদায় নিয়ে এসে ম্যাকিয়াভেলী আধুনিক রাজনীতির পুরোধা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন। তবে দ্বৈত নীতির কথা বলে তিনি কিন্তু প্রকান্তরে নীতিশাস্ত্রের গুরুত্বকে স্বীকার করে নিয়েছেন। উভয় শাস্ত্রের মধ্যে পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও নীতিশাস্ত্র এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কে আবদ্ধ।
Comments
Post a Comment