*
রাষ্ট্র ও সমাজ দুটি ভিন্নধর্মী সংগঠন। মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে যে সংস্থার সৃষ্টি হয় তাই সমাজ। ম্যাকাইভার বলেন “Society is the whole system of social relationship.” সমাজ হচ্ছে গোটা সামাজিক সম্পর্কের ব্যবস্থা । যেখানেই মানুষ পরস্পর স্বেচ্ছায় একত্রিত হয়েছে সেখানেই সমাজ গড়ে উঠেছে। এডমন্ড তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থ, Reflection of the Revolution in France-এ উল্লেখ করেছেন যে সমাজ একটি সংঘবদ্ধ প্রতিষ্ঠান। গিডিংসের মতে, “সমাজ বলতে এমন এক সংঘবদ্ধ জনসমষ্টিকে বুঝায় যারা কোন সাধারণ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য মিলিত হয়েছে।” সমাজ সকল সংঘ ও প্রতিষ্ঠানকে অন্তর্ভুক্ত করে। রাষ্ট্র সমাজের এক প্রধান সংগঠন। প্রাচীন গ্রীক চিন্তাবিদগণ অনেকেই রাষ্ট্র ও সমাজকে এক করে দেখেছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এরিষ্টটল এবং প্লেটো রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে কোন পার্থক্য করেন নি। রাষ্ট্র ও সমাজকে এক করে দেখার অর্থ সামাজিক বিষয়ে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ স্বীকার করা। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করেছেন নিম্নরূপভাবে:-
১। সমাজের পরিধি রাষ্ট্র অপেক্ষা বৃহত্তর। সমাজ থেকেই রাষ্ট্রের উৎপত্তি। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় সমাজকে মাতা বললে রাষ্ট্রকে সন্তান হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। রাষ্ট্র হলো সমাজের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক সংগঠন। সমাজের সংঘবদ্ধ জনসমষ্টি রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হয়ে রাষ্ট্র গঠন করে।
২। সমাজ মানুষের স্বতঃস্ফুর্ত কামনার ফসল। সমাজ ব্যবস্থা এমন কতকগুলো সম্বন্ধের উপর প্রতিষ্ঠিত যা কখনও শাসনতন্ত্রের অধীন নয়। রাষ্ট্র অপেক্ষা সমাজের উদ্দেশ্য ব্যাপক ও বিস্তৃত। সমাজের বহুবিধ কাজের মধ্যে রাষ্ট্র শুধু রাজনৈতিক কার্যাদি সম্পন্ন করে কিন্তু সমাজ বহুসংখ্যক কাজের সংমিশ্রণ। সমাজে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় বহুবিধ কাজ সম্পাদিত হয়।
৩। রাষ্ট্র ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে অবস্থিত। কিন্তু সমাজের সুনির্দিষ্ট কোন সীমা নেই। সমাজের সঙ্গে ভূখন্ডের কোন সম্পর্ক নেই। সমাজ ছোট বা বড় হতে পারে। এমনকি বিশ্বব্যাপী হতে পারে। যেমন খ্রিষ্টান সমাজ, মুসলিম সমাজ, বৌদ্ধ সমাজ, রেডক্রস সোসাইটি ইত্যাদি।
৪। রাষ্ট্র সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী, কিন্তু সমাজের সার্বভৌম ক্ষমতা নেই। সমাজ প্রচলিত প্রথা, রীতি-নীতি দ্বারা মানুষের আচরণ ও কাজকে নিয়ন্ত্রণ করে। সমাজ শক্তি প্রয়োগ করতে পারে না। কোন ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রের আইন অমান্য করলে বিধিবদ্ধ আইন ও কর্তৃত্বের দ্বারা রাষ্ট্র আইন ও আদর্শ লঙ্ঘনকারীর বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ করতে পারে। এমনকি গুরুতর অপরাধের জন্য মৃত্যুদন্ড প্রদান করতে পারে ।
৫। সকলকেই রাষ্ট্রের সদস্য হতে হয়। রাষ্ট্রের সদস্য পদ বাধ্যতামূলক, কিন্তু সমাজের সদস্যপদ স্বেচ্ছাধীন । কেউ কোন সমাজের সভ্য হতে পারে আবার নাও হতে পারে। আবার কেউ একাধিক সমাজের সভ্য হতে পারে। এখানে রাষ্ট্রে সীমাবদ্ধতা রয়েছে । রাষ্ট্রের অনুমতি ব্যতীত কেউ রাষ্ট্রের বাইরে যেতে পারে না। বিশেষ ব্যতিক্রম ছাড়া একই সঙ্গে কোন নাগরিক একাধিক রাষ্ট্রের সদস্যপদ গ্রহণ করতে পারে না।
সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে রাষ্ট্রের কার্যক্ষেত্র সংকুচিত ও প্রসারিত হয়। তৎকালীন সামাজিক অবস্থার আলোকে মধ্যযুগে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে সামাজিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। আবার সামাজিক প্রয়োজনেই গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ব্যক্তি স্বাধীনতা স্বীকৃত হয়েছে এবং কর্মক্ষেত্র প্রসারিত হয়েছে।
Comments
Post a Comment